গত বছর আমাদের দুর্গা পুজো পঁচাত্তর তম বর্ষ অতিক্রম করল। সবই হল, কিন্তু কোথায় যেন একটু মন খারাপ মিশে রইল। আসলে আমাদের পুজোয় কয়েকজন মানুষের অভাব আজও ভোলা যায়না। অটলদা তাদের একজন। খালি পায়ে একটা আধ ময়লা খাটো ধুতি, ফতুয়ার ওপর কোমরে গামছা বেঁধে প্রতি বছর পঞ্চমীর দিন সাত সকালে হাজির হয়ে যেতো আমাদের অটল দা, এই তো বছর পনের আগেও। নাম জিজ্ঞেস করলে এক গাল হেসে বলত শ্রী অটল চন্দ মন্ডল, পোন্ড ক্ষত্রিয়। আর সাথে সাথে তিন পুরুষ মায় কাকার নামটা অব্দি গড়্গড় করে বলে শেষে সাকিনে এসে থামত। বয়েস, তা হয়ত ৭৫ তখন। কোটরাগত দুটো ভাঁটার মত ঘোলাটে চোখ। ভুরুর চুল চোখ অবধি নেমে এসেছে। দন্ত বিহীন মুখে, গাল দুটো ভীষন রকম তোবড়ানো, হয়তো অত্যাধিক বিড়ি খেত বলে। অপুষ্টিতে ভোগা চেহারা দেখে মনে হত আর বোধহয় আসবে না। কিন্তু আসত, প্রতি বছর আসত অটলদা, সেই বিদ্যেধরপুরের ওদিক থেকে। পুজোর ফাই ফরমাস খাটতে খাটতে সেই কবেই এটা ওরও পুজো হয়ে গিয়েছিল । আমরা জ্ঞানত দেখতাম অটলদা আসছে। তারপর আমাদের আগের ব্যাচ পুজো ছাড়লো, আমরা এলাম। অটলদা কিন্তু রয়ে গেল স্ব মহিমায়। ঠাট্টা ইয়ার্কি সব চলত অটলদার সাথে। মনে পড়ে পুজোর পঞ্চাশ বছরে আমরা কজনায় অটলদাকে সেলুনে নিয়ে গিয়ে মাথায় কলপ করিয়ে চন্দন পড়িয়ে বর সাজিয়ে এনেছিলাম, পাঞ্জাবীর নীচে কোমরের গামছাখানি সগৌরবে উঁকি দিচ্ছিল ।(তখন আমরা সবে কৈশোরে পড়েছি)। তাতেই মহা খুশি ওই গ্রাম্য সরল মানুষটি। কোন এক বছর ঠাকুরের জন্য আনা দর্পণ পাওয়া যায় না। খোঁজ খোঁজ। দেখা গেলো আড়ালে লুকিয়ে অটলদা ওই দর্পণ দেখে দাড়ি কাটছে। মদ ছোঁয়নি কখনো। একবার মনে আছে থামস আপ খেতে দেওয়া হলে মুখে নিয়ে মদ ভেবে থু থু করে ফেলে দিয়েছিল । এতটাই সরল ছিল। আরতি আর বিসর্জনে কোমর দুলিয়ে সে কি নাচ তার, ঠিক যেন শিশু। সেবার দুগগা ঠাকুরের তিনটে অসুর হয়েছিল । প্রতি বছরের ন্যায় মন্ডপের সামনেই শুয়েছিল অটলদা । পরের দিন গিয়ে শুনি হৈ হৈ কান্ড । অটলদার নাকি সারা রাত ঘুম হয়নি, বলে "যতবার দু চোখের পাতা এক করি, মনে হয় ওই তিনটেতে হাঁ করি গিলতি আসতিচে" । পুজো চলাকালীন অটলদার গৃহিনী এসে কিছু টাকা অটলদার কাছ থেকে নিয়ে যেত। আমাদের সামনে আসতনা কোনোদিন। তবে যেদিন আসত, আড়াল থেকে কত্তা গিন্নীর বিড়িতে সুখটান দেওয়া দেখতাম। আমাদের বলত "দেখনি তো আমার উনিকে! এখনও একবার বিয়ে দেওয়া যায়। আহা, যা রূপ এখনও।" গ্রামে, নিজের লাঠি খেলার গল্প শোনাতো খুব। আমরা বিশ্বাস করিনি । বলত, "এই পাকা মাটিতে দেঁইরে বলতিচি, বিশ্বাস কর " । প্রমাণ অবিশ্যি দিয়েছিলো সে। সত্যিই লাঠি হাতে ওই বৃদ্ধ মানুষটির এক অন্য মুর্তি দেখেছিলাম সেদিন। পুজো আসে পুজো যায়, কিন্তু আমাদের কাছের সেই মানুষটি আর আসে না, বাঁশের মাচায় চেপে সেই কবেই চলে গেছে মহাপ্রস্থানের পথে । ভারাক্রান্ত, বিষন্ন নবমীর দুপুরে আমাদের সামনে বসে মাইক্রোফোন হাতে বেসুরো গলায় কেউ আর গেয়ে ওঠে না "ঝড় উটিচে, বাউল বাতাস আচকে হোলো সাতি।"
তখন আমরা সদ্য কিশোর, দুর্গাপুজোয় কাজ বলতে পুজোর আগে নাওয়া খাওয়া ভুলে সিনিয়রদের পিছনে ফেউ এর মত লেগে থাকা, পুরোনো বিলবই এর কাউন্টার প্যাড বওয়া, আর ফাইফরমাস- যেমন কমিটির কোনো সিনিয়র হয়তো এক প্যাকেট সিগারেট এনে দিতে বল্লে নিজেকে ধন্য মনে করতাম। সে যাই হোক, সেই সময় প্রতিমা গাড়ি থেকে নামিয়ে মঞ্চে তোলা বা মঞ্চ থেকে নামিয়ে গাড়িতে তোলা বা বিসর্জন- সবই নিজের হাতে করত সিনিয়ররা। আমরা একটু আধটু কাঠবেড়ালি সাজলেও বেশিরভাগ সময় দূরে দাঁড়িয়ে দেখতাম। তা সেবছর পুজো শেষ। প্রতিমা নামানো হচ্ছে প্ল্যাটফর্ম থেকে। এমনই সময় ঘটল সেই অঘটন। হুড়মুড় করে সেই প্রায় বারো ফুটের প্রতিমা এক্কেবারে সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। চারদিকে গেল গেল রব, ছোটাছুটি দু একজনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না কিছু পরে দেখা গেল প্রতিমার নীচ থেকে হামা দিয়ে বেরিয়ে আসছে তারা। খানিক আহতও হয়েছিল। তবে কান্না দেখেছিলাম বটে সেবার। আন্তরিকতা কোথায় গেলে মানুষ অমন কাঁদতে পারে না দেখলে বিশ্বাস হবে না! এরপর সেই অর্ধেক ভাঙ্গা প্রতিমা নিয়েই যাওয়া হয়েছিল বিসর্জনে। তখন এখনকার মত ঠাকুর বওয়ার জন্যে লোক পাওয়া যেত না। পরের বছর লোক খোঁজা শুরু হল আর মিলেও গেল একটা টীম। বছর তিরিশের প্রশান্ত সর্দার যাদের লিডার। কুলি বল্লেও ওরা কিন্তু পেশাগত ভাবে কুলিগিরি করে না, সারা বছর চাষাবাদ করে। তখন সেইভাবে হাতও পাকেনি ঠাকুর তোলায়। তবু এ মন্দের ভালো। আমাদের আর চিন্তা রইল না, টাকা দেব কাজ বুঝে নেব। ঠাকুরের একটুও অঙ্গহানি হলে চলবে না, বিসর্জনে মুর্তির সকল অংশ যেন সরাসরি জলে পড়ে। তা না হলেই টাকা কাটা। মাঝে মাঝে দু এক ঘা ওদের পিঠেও যে পড়েনি হলফ করে সেকথাও বলতে পারিনে। বুঝতাম আমরা টাকা দিয়ে নিশ্চিন্ত হলেও কতখানি ঝুঁকি নিয়ে ওরা কাজ করে। গাড়ির ওপর থেকে দুপাশে বিশাল মোটা বাঁশ মাঝখানে দড়ি দিয়ে বেঁধে দোনলায় মা`কে বসিয়ে কি অদ্ভূত নিপুণতার সাথে ঘাট অবধি নিয়ে যায়। তারপর ভরা বর্ষার টলটলে গঙ্গাবক্ষে শ্যাওলা ধরা সিঁড়ি এঁটেল মাটি। পদে পদে বিপদ তবু কেমন যেন মায়া, প্রতিমার সাথে একাত্ম হয়ে যায় ওরা। আগে প্রশান্তদা কাঁধ দিত এখন পারেনা, পিছন থেকে কাছি ধরে রাখে। সবদিক রক্ষা করে প্রশান্তদাকে সাবধানে ঠাকুর বিসর্জন দিতে বল্লে, বলে "বাংলা ইস্কুলের ঠাকুর মানে আমাদেরও ঠাকুর, ডাঙায় ঠাকুর পড়বে না। দেখে নিও।" তবু যে বছর বৃষ্টি কম হয়, জল নেমে যায়, নীচের কাঠামো মাঝে মাঝে জলের বাইরে সিঁড়িতে পড়ে। টাকা কাটা হয়না, তবু কিছু কটূক্তি এদিক ওদিক থেকে ভেসে আসে। গায়ে মাখেনা ওরা। গরীব গুর্বো মানুষগুলোর সাথে বছরে একবারই দেখা হয়। বছরে বছরে বয়সের কারণে লোক পাল্টায়, দলে উঠতি যুবক আসে। ঠাকুর ফেলে টাকা নিয়ে মিস্টি মুখ করে চলে যায় ওরা। ঠাকুর ভাসিয়ে হেঁটে ফেরার পথে প্রশান্তদার মুখেই শুনেছিলাম প্রশান্তদার তরুণ বয়সের গল্প- পাড়ায় দুর্গা পুজো করার মত আর্থিক সঙ্গতি ওদের নেই তাই ছেলে-ছোকরারা সেই বছর ঠিক করে সবাই মিলে কালীপুজো করবে, ওই একটা দিন পাড়ার সবাই একসাথে খুব হৈ হৈ করবে। শুরু হয় বাড়ি বাড়ি চাঁদা তোলা, গাড়ি ধরা। একবার কোনো এক বড়লোকের বাড়ি গিয়ে শুনতে হয়- "হুঁ! ইনকাম করার মুরোদ নেই, পুজো করছে!" এই কথা প্রশান্তদার জ্যাঠামশাই এর কানে এসে পৌঁছায়। বাড়ি ফিরলে ভাইপোকে যথেষ্ঠ বকা ঝকা করেন। জেদ চেপে যায় প্রশান্তর, পরের দিনই মিটিং করে ওরই সমবয়সী দশ বারোজনকে নিয়ে। ঠিক করে, নাঃ টাকার জন্যে আর দোরে দোরে ঘুরবে না। পরের বছরেই দুর্গা পুজোর আগে চলে আসে শহরে। প্রথম প্রথম ঠাকুর বওয়ার কাজটা অত সহজ ছিল না, চেষ্ঠায় কী না হয়! কয়েক বছরেই এই কাজে পটু হয়ে ওঠে ওরা। ওদের পরিচয় হয়ে যায় কুলি। "বিশ্বাস করো এর এক পয়সাও আমাদের নিজেরা নিই না। এ সব টাকা যায় কালীপুজো ফান্ডে। সম্বৎসর পাড়ার বাচ্ছা-বুড়ো এই আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠে। সবার বাড়ি ওইদিন রান্না বন্ধ। একসাথে খাওয়া। অন্যের কাছ থেকে চাওয়া টাকায় নয়, নিজেদের মেহনত করা, পরিশ্রম করা টাকায়, এ কী কম আনন্দের! প্রতি বছরই হ্যান্ডসেক করে ফিরে যাবার আগে কালীপুজোর নেমন্তন্য করে যায়। শহরের চাকচিক্য বাহুল্যতা ছেড়ে যাওয়া আর হয়ে ওঠেনা, ভুলেই যাই ওদের কথা। ওই জেদী মানুষগুলোর নিজেদের মেহনত করে উপার্জন করা টাকায় পুজোর কথা। চিত্র সৌজন্যে - Debarsi RoyChowdhury
যে সময়ের কথা লিখছি তখন আমাদের দুর্গা পুজোয় মাণিকদাই প্রধান। তারপরে তরুনদা তপনদাদের গ্রুপ। তারও দুটো ধাপ পরে আমাদের গ্রুপ। তার পরে আরও অনেক ছোটরা। বাঙলা ইস্কুলের দুর্গা পুজোর তখন বিশাল বাহিনী। এমনকি তখন হরিনাভি থেকেও আসত- বাবুদা। সেই সময় মাণিকদার খুব নাম ডাক, আমরাও তখন মাণিকদার ছত্রছায়ায় বেশ নেচে কুঁদে বেড়াতাম। পুজোর ঠিক আগে আগে রোজ অনেক রাত পর্যন্ত আলোচনা চলত বাঁশতলায় বুড়োদার মিষ্টির দোকানের সামনে। তা কমপক্ষে ৪০-৫০ জন তো হবেই । হঠাৎ সেদিন কে যেন বাজি ধরল- এক ট্রে দানাদার খেতে পারলে ১০০ টাকা দেওয়া হবে । তখনকার দিনে ১০০ টাকা মানে বিরাট ব্যপার। তপনদা সাথে সাথে বাজি এক্সেপ্ট করল। ট্রে এল, তপনদা ট্রে নিয়েই একের পর এক দানাদার খেতে আরম্ভ করে দিল। আমরা ছোটরা তো লোভ চকচক চোখে তাকিয়ে আছি। ট্রে থেকে তপনদার মুখ অবধি আমাদের দৃষ্টি ওঠানামা করছে আর ভাবছি তপনদা নির্ঘাৎ পারবে না, শেষে আমরাই ভাগ পাবো। যা ভেবেছি ঠিক তাই - তপনদা পারলনা আর আমরা ছোটরা ঝাঁপিয়ে পড়লাম ট্রের ওপর। নিমেষে সব দানাদার উধাও। ঠিক তখনই হঠাৎ মন্টুদা বল্ল "আচ্ছা, ওই এক ট্রে বোঁদে নিয়ে কেউ বাজি ধরবি না?" আমার বড়দা, মানে বিচ্চুদা বাজি ধরল, মন্টুদা বোঁদের ট্রে টেনে নিয়ে বল্লে "বিচ্চু, এট্টু দইএর ছিটে হবে না ? সাথে সাথে এক কিলো একটা দইএর ভাঁড়ও চলে এল বুড়োদার দোকানের ভেতর থেকে। মন্টুদা বোঁদের ঠিক মাঝখানে একটা বড় গর্ত করে পুরো দইটা সেখানে ঢেলে দিল। এরপর অনেকটা সিমেন্ট বালি মাখার মত মেখে, খেতে আরম্ভ করল। আমাদেরও হাতে চাঁদ তখন। মন্টুদাও পারবে না..... আহা, দানাদারের পর এবার বোঁদে! সবাই ঝাঁপাতে রেডি...... কিন্তু নাঃ! কপাল খারাপ। এবারে আর বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল না । মাত্তর ১৫ মিনিটে সব বোঁদে সাবাড়। খাওয়া শেষ করে একটা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে টেনিদার স্টাইলে মন্টুদা বল্ল-"বিচ্চু, গুঁজিয়াগুলোর কি হবে?" বেগতিক বুঝে বড়দা বল্লে -`তুই যা পারিস খা। আর, উতু- তোরা বাড়ি যা, নো মোর চান্স।" আমাদের বড় সর্দার মাণিকদা বললে- "বুড়োদা এদের সব একটা করে মিষ্টি দিয়ে দাও।" বড় আনন্দের ছিল সেই পুজোর মধুমাখা দিনগুলো। বড়দের ভালোবাসায় আর প্রশ্রয়ে বড় আনন্দে দিন কাটিয়েছি । ঠাকুর আসার পর কতবার যে বাঙলা ইস্কুল ছুটে যেতাম। ভাবখানা এমন, "সব ঠাকুর একবার, বাঙলা ইস্কুল বারবার।" তখন পুজো উপলক্ষ্যে যাত্রা হত। ভ্যানে করে ভোম্বলদা, আমি, মান্টি, খোকা- দূর দূরান্তে কত যে প্রচারে গেছি। এক এক দল, এক এক দিকে যেতাম । সারাক্ষণ টো টো কোম্পানী, শুধু খেতে বাড়ি যেতাম । এরপর ক্রমে ক্রমে পুজো বড় হল- নবদুর্গা এল। মনে আছে, সেবার গড়িয়ার মিতালি সঙ্ঘের তপেশ ধর বাবুও পুজো দেখতে এসেছিলেন। মাণিকদাকে তখন একডাকে অঞ্চলের সবাই চেনে। তারও আগেকার কথা। তখন প্যান্ডেল আরম্ভ হত মহালয়ার দিন থেকে। আমাদের তখন বাঁশে ঝোলার বয়েস। আমি, শক্তি, তরুন,খোকো,কাবলু আরও আরও কতজন। তখন অনন্তদা, মানে অনন্ত বিমল কানুনগো দা`দের যুগ। তখন প্রতি বছর বই ছাপানো হত আর তাতে আগের বছরের জমা খরচের হিসাব থাকত। আর পাড়া হিসাবে কে কত চাঁদা দিল নাম দিয়ে দিয়ে তা লেখা থাকত। সব্বাই তার দেওয়া চাঁদার সাথে জমা খরচের খাতাতে তার নামে লেখা টাকা মেলাতে পারত। এখন বুঝি কত স্বচ্ছতা ছিল সেই হিসাব রাখায়! যতদূর মনে পড়ে, সেই সময় আয়-ব্যয়ের হিসাবে মোট টাকার পরিমাণ হত ২৭৫০ টাকার আশপাশে। আহা! সেই বুকলেট যদি কোথাও পাওয়া যায়, খুব মজা লাগবে।
তখন সবে সবে স্কুলে ভর্তি হয়েছি। সালটা ১৯৭৮, সেপ্টেম্বরের শেষ। প্রবল বন্যায় সমস্ত পশ্চিমবঙ্গ ভাসছে। আমাদের রাজপুর আদি গঙ্গার পাড়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ভেসে গেছে। চৌহাটি অঞ্চল থেকে প্রচুর মানুষ একটু আশ্রয়ের সন্ধানে আমাদের বিদ্যানিধি স্কুল, ওরফে বাংলা স্কুলে এসে উঠেছেন। পুজোর মধ্যে জল নামার কোনো চান্স নেই। অথচ এই স্কুলেই যে আমাদের দুর্গাপুজো হয়। বড়দের যত না চিন্তা, আমাদের আরও বেশি। পুজো আদৌ হবেতো!! সেই সময় মুখে যেই শুনতাম বাংলা স্কুলে বাঁশ পড়েছে, মনটা আনন্দে নেচে উঠত। আসলে আমাদের ৭৬ বছরের রাজপুর সার্বজনীন দুর্গোৎসব এই বাংলা স্কুলেই হ`য়ে আসছে। যাইহোক, অবশেষে পুজো হ`ল। মনে আছে, পুজোর চারদিন সেইসব পরিবারের দু-চারজন সমবয়সী বাচ্চার সাথে বেশ বন্ধুত্বও হয়ে গিয়েছিল। সেই বছরই আমাদেরই বয়সীই একটি বাচ্চা মেয়ে অন্তরা চৌধুরী গান রেকর্ড করেছিল "আয়রে ছুটে আয় পুজোর গন্ধ এসেছে।" "এক এক্কে এক, দুই এক্কে দুই" গানটার পাশাপাশি এই গানটিও পুজোয় যেন নতুন মাত্রা এনে দিয়েছিল। মনে হত, আরেঃ এতো আমাদের কথাই বলছে। হাতে ক্যাপ বন্দুক আর গ্যাস বেলুনে পুজোর ক`দিন নিজেকে বেশ কেওকেটা মনে হ`ত। তখন নবদুর্গা হ`ত। মনে আছে মন্ডপ অন্ধকার করে প্রোজেক্টারে স্টিল ছবি দেখানো হ`ত, সংগে চন্ডী পাঠ। আমরা বলতাম ভ্যানিস। কার্ত্তিক ঠাকুরের পাশে ফাঁকা পর্দায় নীচ থেকে উপরে উঠে যেত দুর্গা ঠাকুরের নানান ছবি। হরিনাভি থেকে হাবু দা আসত পুজো করতে। অঙ্গে গৈরিক বস্ত্র মাথায় পাগড়ি। যেন সাক্ষাৎ বিবেকানন্দ,আহা! আরতি দেখতে দেখতে চোখ জুড়িয়ে যেত। খুব অল্প অল্প স্বপ্নের ম`ত মনে আছে। তারপর হাবুদা কামাক্ষ্যা না কোথায় যেন চলে গেল। ঠিক করে দিয়ে গেল পাঁচু দা কে, সেও আজ প্রায় বছর চল্লিশ। সেই থেকে আজতক পাঁচুদাই পুজো করছে। চল্লিশ বছরে হয়ে উঠেছে আমাদেরি একজন। চেনা পুরোনো মানুষগুলো কেমন হারিয়ে যাচ্ছে চারপাশ থেকে। আগে সাইকেলে আসত, এখন আসে রিক্সায়। জানিনা আর কদিন পারবে! বছরের যেকোনো সময় যাদের দেখলে প্রথমেই দুর্গা পুজোর কথা মনে আসে পাঁচুদা তাদের একজন, আমাদের সাবেকী দুর্গা পুজোর চল্লিশ বছরের সাক্ষী। আজও অঞ্জলি মন্ত্র সরণ্যেত্র্যাম, বকে গৌরী বলানোর সময়- মনে মনে হাসি পেলেও জানি, আমাদের গৌরী তাতে কিছুমাত্র বিচলিত হন না। চল্লিশ বছরের ভালোবাসা জড়িয়ে আছে যে!
তখন সবে সবে স্কুলে ভর্তি হয়েছি। সালটা ১৯৭৮, সেপ্টেম্বরের শেষ। প্রবল বন্যায় সমস্ত পশ্চিমবঙ্গ ভাসছে। আমাদের রাজপুর আদি গঙ্গার পাড়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ভেসে গেছে। চৌহাটি অঞ্চল থেকে প্রচুর মানুষ একটু আশ্রয়ের সন্ধানে আমাদের বিদ্যানিধি স্কুল, ওরফে বাংলা স্কুলে এসে উঠেছেন। পুজোর মধ্যে জল নামার কোনো চান্স নেই। অথচ এই স্কুলেই যে আমাদের দুর্গাপুজো হয়। বড়দের যত না চিন্তা, আমাদের আরও বেশি। পুজো আদৌ হবেতো!! সেই সময় মুখে যেই শুনতাম বাংলা স্কুলে বাঁশ পড়েছে, মনটা আনন্দে নেচে উঠত। আসলে আমাদের ৭৬ বছরের রাজপুর সার্বজনীন দুর্গোৎসব এই বাংলা স্কুলেই হ`য়ে আসছে। যাইহোক, অবশেষে পুজো হ`ল। মনে আছে, পুজোর চারদিন সেইসব পরিবারের দু-চারজন সমবয়সী বাচ্চার সাথে বেশ বন্ধুত্বও হয়ে গিয়েছিল। সেই বছরই আমাদেরই বয়সীই একটি বাচ্চা মেয়ে অন্তরা চৌধুরী গান রেকর্ড করেছিল "আয়রে ছুটে আয় পুজোর গন্ধ এসেছে।" "এক এক্কে এক, দুই এক্কে দুই" গানটার পাশাপাশি এই গানটিও পুজোয় যেন নতুন মাত্রা এনে দিয়েছিল। মনে হত, আরেঃ এতো আমাদের কথাই বলছে। হাতে ক্যাপ বন্দুক আর গ্যাস বেলুনে পুজোর ক`দিন নিজেকে বেশ কেওকেটা মনে হ`ত। তখন নবদুর্গা হ`ত। মনে আছে মন্ডপ অন্ধকার করে প্রোজেক্টারে স্টিল ছবি দেখানো হ`ত, সংগে চন্ডী পাঠ। আমরা বলতাম ভ্যানিস। কার্ত্তিক ঠাকুরের পাশে ফাঁকা পর্দায় নীচ থেকে উপরে উঠে যেত দুর্গা ঠাকুরের নানান ছবি। হরিনাভি থেকে হাবু দা আসত পুজো করতে। অঙ্গে গৈরিক বস্ত্র মাথায় পাগড়ি। যেন সাক্ষাৎ বিবেকানন্দ,আহা! আরতি দেখতে দেখতে চোখ জুড়িয়ে যেত। খুব অল্প অল্প স্বপ্নের ম`ত মনে আছে। তারপর হাবুদা কামাক্ষ্যা না কোথায় যেন চলে গেল। ঠিক করে দিয়ে গেল পাঁচু দা কে, সেও আজ প্রায় বছর চল্লিশ। সেই থেকে আজতক পাঁচুদাই পুজো করছে। চল্লিশ বছরে হয়ে উঠেছে আমাদেরি একজন। চেনা পুরোনো মানুষগুলো কেমন হারিয়ে যাচ্ছে চারপাশ থেকে। আগে সাইকেলে আসত, এখন আসে রিক্সায়। জানিনা আর কদিন পারবে! বছরের যেকোনো সময় যাদের দেখলে প্রথমেই দুর্গা পুজোর কথা মনে আসে পাঁচুদা তাদের একজন, আমাদের সাবেকী দুর্গা পুজোর চল্লিশ বছরের সাক্ষী। আজও অঞ্জলি মন্ত্র সরণ্যেত্র্যাম, বকে গৌরী বলানোর সময়- মনে মনে হাসি পেলেও জানি, আমাদের গৌরী তাতে কিছুমাত্র বিচলিত হন না। চল্লিশ বছরের ভালোবাসা জড়িয়ে আছে যে!
Contact us and we'll get back to you within 24 hours.
Aghore Sarani, Banstala, P.O.- Rajpur,Kolkata-7001496289639108, 9339207911
8910201371, 8961316618, 9051231325
rsdc700149@gmail.com